তুলসী খুব পবিত্র একটি গাছ । এবং এই গাছের গুরুত্ব ও বৈশিষ্ট্য আয়ুর্বেদ ও নানা চিকিৎসার ক্ষেত্রে ভীষণভাবে উল্লেখ করা আছে। তুলসী বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। যেমন, রাম তুলসী, কৃষ্ণ তুলসী ও বান তুলসী। পূজাতে সবসময়ই তুলসী পাতা ব্যবহার করা হয়। এই যে বিভিন্ন ধরনের তুলসী গাছ প্রত্যেকেরই বিভিন্ন রকমের অসুস্থতাকে চিকিৎসা করাতে সমানভাবে কার্যকরী। প্রায় 5000 বছর ধরে এই তুলসী গাছ আমাদের এই ভারতবর্ষের উত্তর-পূর্ব মধ্য অঞ্চলে চাষ করা হয়ে
থাকে। তবে বর্তমানে এটি ভারতবর্ষের সমস্ত এলাকায় চাষ করা হয়। তাছাড়া বিদেশেও এর ব্যবহার আছে।
তুলসীর বৈজ্ঞানিক নাম:
তুলসীর বৈজ্ঞানিক নাম হল Ocimum Sanctum. গন:Ocimum. জগত: Plantae. পরিবার:Lamiaceae. প্রজাতি:O.tenuiaceae. বর্গ: Lamiales. তুলসী একটি ঔষধি গাছ যার অর্থ তুলনা নেই। তুলসী গাছ লামিয়াসি পরিবারের অন্তর্গত একটি সুগন্ধি উদ্ভিদ। হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে এটি একটি পবিত্র উদ্ভিদ। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে তুলসীকে ‘সীতা স্বরূপা’, ইসকন্দ পুরাণে ‘লক্ষ্মীসরুপা ‘, চর্ক সংহিতায় ‘বিষ্ণুপ্রিয়া’, রিক বেদে ‘
কল্যাণী’, বলে তুলসীকে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
তুলসী পাতার উপকারিতা:
তুলসী পাতায় রয়েছে এন্টি ইনফ্লেমেটরি ও এটি অক্সিডেন্ট উপাদান যা ক্যান্সার, ডায়াবেটিস বা হৃদরোগের মত নানা মারাত্মক রোগ নিরাময় করতে পারে। যথা:
মানসিক চাপ:
অনেক দেশে তুলসীকে মানসিক চাপমুক্ত করার অসাধারণ ওষুধ হিসেবে গণ্য করা হয়। বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধক উপাদান থাকায় সারাদিনের ক্লান্তি ও চাপ নিমেষের মধ্যে এই তুলসী পাতা ব্যবহারে দূর করতে পারে। তুলসী শরীরের পল্টিশন মাত্রা কমিয়ে আনতে পারে এবং অতিরিক্ত উত্তেজনা ও চাপ থেকে মুক্তি দিতে পারে। তুলসী পাতা ব্যবহারে শরীরের অন্তর্নিহিত শক্তি জেগে ওঠে এবং ধীরে ধীরে চাপ কমে আসে।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা:
বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় প্রমাণিত যে তুলসী পাতায় অসাধারণ রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা রয়েছে। যেমন ফুসফুসের সমস্যা, ব্রংকাইটিস, ঠান্ডা লাগা ইত্যাদি। সর্দি কাশি হলে বুকে কফ বসে যায় তুলসী পাতা তরল করে সেবনে খুব সহজে এটি সেরে ফেলা যায়। জ্বরের সময় তুলসী পাতা খুবই উপকারী। বর্ষাকালে তুলসী পাতা ও এলাচ ভালো করে জলে ফুটিয়ে সেই জল পান করলে নানারকম রোগের থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। বিভিন্ন অপারেশনের পর ক্ষতস্থানে তুলসী পাতা বেটে লাগালে তা বেশ দ্রুত শুকিয়ে ওঠে। এই পাতা দিয়ে সুগারের মাত্রা কমানো যায় ।
ওজন কমানো:
তুলসী পাতার দ্বারা রক্তে সুগারের মাত্রা কমানো যায় এবং কোলেস্টেরল রোধ করা যায় যার জন্য ওজন বৃদ্ধির হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায় । গবেষণায় প্রমাণিত ২৫০ মিলিগ্রামের একটি ক্যাপসুল যা তুলসী দিয়ে তৈরি প্রতিদিন খাওয়ার ফলে ওবেসিটি ও লিপিড প্রোফাইল মারাত্মকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
দাঁতের স্বাস্থ্য:
তুলসী দিয়ে তৈরি নানা রকম টুথপেস্ট ও মাউথ ওয়াশ তৈরি করা যায় যা দাঁতের জন্য খুবই উপকারী। তাছাড়া এতে এন্টি মাইক্রোবিয়াল উপাদান যা দাঁতের যেকোনো সমস্যা নারীর সমস্যা ও মুখের দুর্গন্ধ দূর করতে সাহায্য করে।
চোখের সমস্যা:
কমবেশি সকলেরই চোখের সমস্যা থাকে। যেমন চুলকানি, লাল হয়ে যাওয়া, জল বা পিছুটি কাটা ইত্যাদি। তুলশিতে থাকা এন্টি ইনফ্লেমেটরি উপাদানগুলি চোখের এই যাবতীয় সমস্যা দূর করতে পারে। সানি সমস্যা ও দৃষ্টিশক্তির সমস্যাও দূর করতে তুলসী পাতা খুবই কার্যকরী।
মাথা যন্ত্রণা:
তুলসী পাতার রস বা গুড়া চা পাতার সাথে মিশিয়ে প্রতিদিন দুইবার করে পান করলে মাথা ব্যথা নিমেষে কমে যায়।
হার্টের জন্য:
বর্তমান সময়ে হার্টের সমস্যা ভীষণভাবে বেড়ে গেছে যা মৃত্যুরও বড় একটা কারণ। হার্টের রোগ জন্ম নেয় সাধারণত হাইপারটেনশন উচ্চ রক্তচাপ বা ক্লোস্টরলের কারণে। তুলসী পাতার সাহায্যে রক্তের জমাট বাধার সমস্যা দূর করা যায় এবং হার্ট অ্যাটাক রোধ করা যায়।
গলা ব্যথা:
গলা ব্যথার জন্য তুলসী পাতার জুড়ি মেলা ভার তাছাড়া শ্বাসকষ্টের সমস্যা কমাতেও তুলসী পাতা বিশেষ উপকারে একটি তুলসী পাতা দিয়ে ফুটিয়ে রোজ গারগেল করলে গলা ব্যথা সহজেই সেরে যায়।
ক্যান্সার:-
ক্যান্সার রোগ প্রতিরোধ করতে তুলসী পাতা খুবই উপকারী। এতে রয়েছে রেডিও প্রটেকটিভ উপাদান যা টিউমারের কোষগুলিকে মেরে ফেলতে সাহায্য করে। তুলসী পাতায় থাকা ফাইটোকেমিক্যাল যেমন রোশ মারিনিক এসিড ,মাই রেটিনাল, লিউটিউলিন এবং এপি জেনিন ক্যান্সারের বিরুদ্ধে কাজ করতে বিশেষ কার্যকরী। অগ্নাশয় টিউমার এবং ব্রেস্ট ক্যান্সার রোধ করতেও তুলসী পাতা খুবই উপকারী।
ডায়াবেটিস:
টাইপ টু ডায়াবেটিসে ভোগা মানুষদের জন্য তুলসী পাতা ইনসুলিন উৎপাদনের কাজ করে। রক্তে সুগারের মাত্রা কমাতে প্রতিদিন খাওয়ার আগে তুলসী পাতা খাওয়ার অভ্যাস।
সর্দি কাশি কমাতে:
সর্দি কাশি হলে তুলসী পাতা একটি ওষুধের মত কাজ করে। একটি পাত্রে জল নিয়ে তুলসী পাতা আদা ও চা পাতা ভালো করে ফুটিয়ে তাতে মধু ও লেবু মিশিয়ে সকালবেলায় পান করলে খুব শীঘ্রই আরাম পাওয়া যায়।
কিডনি স্টোন:
তুলসীতে যেহেতু এন্টিঅক্সিডেন্ট ও এন টি ব্যাকটেরিয়াল উপাদান আছে তাই শরীরের ভিতর থেকে নানা রকমের বিষক্রিয়া পদার্থ বের করে আনতে সাহায্য করে। যার ফলে ডিহাইড্রেশন কমে যায় এবং কিডনির কার্যকারিতা আবার সচল অবস্থায় ফিরে আসে ফলে কিডনি স্টোন রোধ করা যায়।
পেটের স্বাস্থ্য:
পেট , অম্বল, গ্যাস ,কোষ্ঠকাঠিন্য ইত্যাদি সবকিছুর বিরুদ্ধে তুলসী পাতা খুবই কার্যকরী। পেটে আলসারের বিরুদ্ধেও তুলসী পাতার নানারকম ভূমিকা আছে যা পরীক্ষিত। পেট ব্যথা ও হাইপার এসিডিটি খুব সহজেই কমে যায় যদি কুড়ি মিলিলিটার জলে তুলসী পাতা ভালো করে ফুটিয়ে তা ১০ মিলিলিটার কমিয়ে এ নিয়ে পান করা যায়।
লিভার:-
তুলসী পাতায় হেপাটোও প্রটেক্টিভ উপাদান থাকার কারণে তুলসী পাতা লিভার নষ্ট হওয়ার হাত থেকে সহজে রক্ষা করতে পারে। তবে লিভারের সমস্যা থাকলে ডাক্তারের সাথে কথা বলে তবে তুলসী পাতা খাওয়ার অভ্যাস করতে হবে।
ফোলা ভাব দূর করতে:
শরীরের ফোলা ভাব দূর করতে তুলসী পাতায় থাকা ইউক্যালিপটাল বেশ কার্যকরী। পেইন কিলার হিসেবেও তুলসী পাতা ব্যবহার করা যায়। হাড় বা জয়েন্ট এর যন্ত্রণা থেকেও মুক্তি দেয় এই তুলসী পাতা।
রক্তনালি:
তুলশিতে এন্টি ইনফ্লেমেটরি উপাদান থাকার ফলে রক্তে যাতে কোনরকম জমাট না বাদে তার জন্য তুলসী দারুণভাবে কাজ করে।
ব্রণ:
এন্টি ব্যাকটেরিয়াল ও এন্টিফাঙ্গাল উপাদান থাকার কারণে তুলসী পাতা রক্তের নানারকম বিষাক্ত পদার্থ দূর করে তা বিশুদ্ধ রাখতে সাহায্য করে। তুলসী পাতার একটি পেস্ট বানিয়ে তা চন্দন বা গোলাপ জলের সাথে মিশিয়ে মুখে লাগিয়ে কুড়ি মিনিটের জন্য রেখে দিতে হবে। তারপর সেটি জল দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে তাহলে ব্রণ সব দাগ সবকিছু কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।
ত্বকের সংক্রমণ:
এন্টিবায়োটিক উপাদান থাকার কারণে ত্বকের নানারকম সংক্রমণ দূর করতে সাহায্য করে তুলসী। ২৫০ গ্রাম তুলসী পাতা জলে ভালো করে ফুটিয়ে তিল তেলের সাথে মিশিয়ে মুখে লাগালে ত্বকের সংক্রমনের বিরুদ্ধে কাজ করতে সাহায্য করে।
একজিমা এবং সেঁতি:
প্রতিদিন তুলসী পাতা যদি খাওয়া হয় তাহলে সেতিরোগ সহজে দূরে চলে যায়। তাছাড়া একজিমার মত রোগও বেশ ভালোভাবে নিরাময় করে। তুলসী পাতায় থাকা এন্টিঅক্সিডেন্ট একজিমার বিরুদ্ধে কাজ করে। তবে তুলসী পাতা লাগানোর আগে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া যেতে পারে।
চুলের জন্য:
তুলসী পাতা চুলের গুড়া মজবুত করে এবং চুলের নানারকম সমস্যার বিরুদ্ধে লড়াই করে। কয়েক ফোঁটা নারকেল তেলের খানিটা তুলসী পাতা বাটা মিশিয়ে মাথার ইস্কালপে লাগাতে হবে। ৩০ মিনিট রেখে চুল শ্যাম্পু দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে। এতে করেই চুলের গোড়া মজবুত হবে এবং স্কেলপে রক্ত চলাচল বৃদ্ধি পাবে ও চুল পড়ার সমস্যা ধীরে ধীরে চলে যাবে।
খুশকি দূর করে:
খুশকি দূর করতে তুলসী পাতা খুবই উপকারী। যে তেল চুলে ব্যবহার করা হয় সেই তেলের সাথে একটু তুলসী পাতার রস মিশিয়ে সেটি ভালো করে মাথার এস্কালপে লাগাতে হবে তাতেই খুশকি রোধ করা যাবে এছাড়া মাথায় চুলকানি হলেও তা কমে যাবে। পাকা চুলের সমস্যা দূর করতেও তুলসী পাতা বিশেষ উপকারী। কয়েকটি তুলসী পাতা জলে ভিজিয়ে সারারাত রেখে দিতে হবে তারপর সেটি বেটে তার মধ্যে আমলকির গুঁড়ো মিশিয়ে সেটি ছুলে ভালো করে গোড়া থেকে লাগিয়ে দিতে হবে সকালে উঠে ভালো করে শ্যাম্পু করে ফেলতে হবে তাহলে পাকা চুলের সমস্যা দূর হবে।
তুলসীর ক্ষতিকর দিক:
তুলসী পাতা যতই উপকারই হোক না কেন কিছু কিছু ক্ষেত্রে এটি এড়িয়ে চলাই শ্রেয়। যেমন গর্ব অবস্থায় বা স্তন্যপান করার সময় রক্তপাতের সমস্যায় নিম্ন রক্ত সাপে এই পাতা ব্যবহার থেকে বিরত থাকতে হবে।